শত বছর পর পর পৃথিবীতে বীরদের আগমন ঘটে। তাদের মধ্যে দুএকজন জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমনই এক জনপ্রিয় মুখ, ‘ট্রাম্পি’। ২০১৬ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর জন্ম নেয় ধবধবে সাদা রঙের এক কুকুর ছানা। মায়াবী চেহারা আর খেলুক স্বভাবের কারণে দ্রুত সকলের নজরে আসে এই কুকুর ছানাটি। শাহ এম এস কিবরিয়া হলে তার জন্য ঘর বানিয়ে দেয়া হয় এবং তার নাম দেয়া হয় ট্রাম্পি। প্রাধিকারের সাবেক সভাপতি বিনায়ক শর্মার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বড় হতে থাকে ট্রাম্পি। ধীরে ধীরে সবার সাথে ক্লাসে যাওয়া আসা শুরু করে ট্রাম্পি। ক্লাস চলাকালীন মেঝেতে শুয়ে কিংবা চেয়ারে বসে লেকচার শুনতে থাকে।

 

অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ছাত্র শিক্ষকসহ সকলের ভালো বন্ধু হয়ে উঠে ট্রাম্পি। ক্যাম্পাসের ভিতর সবাই তার আপনজন হয়ে উঠে। অপরিচিত যেকোন মানুষকেও দ্রুত আপন করে নিত সে। যারা কুকুরকে ভয় পেত তারাও নির্ভয়ে ট্রাম্পিকে কাছে ডেকে আদর করত, খাবার দিত। ট্রাম্পির এই বন্ধুসুলভ আচরণ অনেকের কুকুর ভীতি দূর করে প্রানিদের ভালোবাসতে শিখিয়েছে।

ট্রাম্পি ছিল সিকৃবি রাজ্যের সবচেয়ে স্বাধীন প্রাণী। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ধুলিকনা যার পদচারনায় মুখরিত ছিল।কখনো বৈশার্থী চত্বরে কখনো বা শহিদ মিনারে বসে আনমনে এ বন্ধুদের নিয়ে ভাবত। কখনো উদ্দেশ্যহীনভাবে ছুটে চলত ফার্স্ট গেইট থেকে সেকেন্ড গেইট কখনো থার্ড গেইট থেকে টিলা।

ক্যাম্পাসে কোন প্রোগ্রামে বিনা ইনভাইটেশনে ও বিনা পারমিশনে যে ঢুকতে পারত সে হলো আমাদের ট্রাম্পি। সে ছিল একাধারে ছাত্র, সংগঠক, অভিনেতা, মডেল, রাজপথের অগ্র সৈনিক। সে ছিল একমাত্র স্বাধীন ছাত্র যে কিনা ক্যাম্পাসের সকল অনুষদে ক্লাস উপস্থিত থাকত।এক্সাম হলে বন্ধুদের পরিক্ষা চলাকালীন হলের ভিতর কিংবা বাহিরে মেঝেতে মাথা নুইয়ে দোয়া করত আর অপেক্ষা করত কখন শেষ হবে বন্ধুদের পরিক্ষা। বিকেলে বন্ধুদের গানের আসরে যোগ দিত, যোগ দিত সাংগঠনিক আড্ডায়। কখনো কোন বন্ধুর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় যোগ দিত। ছাত্র আন্দোলন কিংবা মিছিলের অগ্র সৈনিক হিসেবেও তাকে দেখা যেত। কখনো বা দেখা মিলত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চের অঘোষিত অভিনেতা কিংবা ফটোগ্রাফারদের মডেল হিসেবে। জন্মদিন পালন, ক্লাসরুম, ট্যুর, রেস্টুরেন্ট খেতে যাওয়া, বিভিন্ন সংগঠনের মিটিং থেকে শুরু করে সকল প্রণামে সে উপস্থিত হয়ে সকলের সাথে সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করত। সকলের আনন্দে যেমন আনন্দিত হত, তেমনি সকলের দুঃখে দুঃখিত হত ।তার এক বন্ধু ওয়াসিম হত্যার প্রতিবাদ করতে সকলের সাথে পায়ে হেটে সিলেটের চৌহাট্টায় গিয়েছিল এবং মসজিদে দোয়ার সময় সে বাহিরে মাটিতে মাথা নুইয়ে দোয়া করেছিল ।তার এই সকল গুনবলী দিয়ে সবার ভালোবাসা অর্জন করেছিল এবং ক্যাম্পাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে সকলের প্রিয় ট্রাম্পির শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করে এবং একসময় তার শরীরে বাসা বাঁধে মরণঘাতি ক্যান্সার। দেশি বিদেশি ও প্রাধিকারিয়ান বন্ধুদের সাহায্যে কেমোথেরাপি নিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে ট্রাম্পি। ক্যান্সার কাটিয়ে উঠতে পারলেও নানারকম রোগ লেগেই থাকতো। প্রাধিকারিয়ান বন্ধুরা তার চিকিৎসা করত। একটু সুস্থ হলেই সে হাসিমুখে আড্ডা দিতো সকলের সাথে।

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে অসুস্থতা জনিত কারণে আমাদের সকলকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যায় ট্রাম্পি। পুরাতন অডিটোরিয়াম সংলগ্ন স্থানে ট্রাম্পিকে সমাধিস্থ করা হয়। ট্রাম্পি তার ছোট জীবনে জয় করেছিল হাজার মানুষের হৃদয়। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের জীবনে যত স্মৃতি থাকে তার থেকে কোন অংশে কম স্মৃতি ছিল না ট্রাম্পির বরং অনেক বেশি স্মৃতি ছিল তার। ছাত্র শিক্ষক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সবার সাথেই কোন না কোন স্মৃতি আছে ট্রাম্পির।

 

লেখক-

আব্দুল্লাহ আল মামুন,

ভাইস-প্রেসিডেন্ট, প্রাধিকার

Categories: Trumi

1 Comment

pradhikar · December 22, 2023 at 11:34 am

আমাদের প্রিয় ট্রাম্পি 💝💝

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *