#CallForWriting2022
স্থানঃ ১ম
প্রবন্ধঃ মানব শিশুর মত প্রাণী শিশুর কান্নাও উপেক্ষণীয় নয়
শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে আমাদের গ্রামের বাড়ি। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় ইভটিজিং এর শিকার হয়ে বাড়ি ছেড়ে শহরে স্কুলের কাছে ভাড়া বাসায় উঠতে হলো। বাড়িওয়ালাকে আমরা হাজী নানা ডাকতাম। বাড়িওয়ালার শহরে বিশাল বড় বাড়ি। এক পাশে ছিল চারটি ঘর আর দেয়ালের আরেক পাশে আটটি ঘর। ঘরের পেছনে বিশাল বড় পুকুর, আর পুকুরে পেছনে অনেক খোলা জমি। আমাদের ভাড়া করা ঘরটা ছিল দু’বাড়ির দেয়ালের ঠিক পাশেই। দেয়ালের শেষে আমাদের ঘরের পাশ ঘেঁষাই ছিল একটি পকেট গেট। গেট পার হলেই বাড়িওয়ালার গোয়াল ঘর। বলতে গেলে পুরো বাড়ি জুড়েই তার ছোটখাট একটা খামার ছিল। আমরা সে বাড়িতে ভাড়া যাওয়ার বছর খানেক পর তিনি একটা গরু কিনলেন। গাভীসহ পুরো বাড়ির দেখাশোনার জন্য বাড়িওয়ালার বয়স্ক, সহজ-সরল এক বিশ্বস্ত কাজের লোক ছিল। নাম ছিল তার মজিবর, যদিও তিনি বাড়িওয়ালার ঘরের সবার কাছে বিলাতি নামেই বেশি পরিচিত ছিল। ছোট খাট গাভীটি বছরখানেক পরই একটি জীর্ণ-শীর্ণ বাচ্চা দিল। হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে আসার কারণে নিজের সব পোষা প্রাণীদের ছেড়ে এসে এ বাড়িতে গাভী আর ওর বাচ্চাটাকে দেখে খুব ভালো সময় কাটত। তবে অল্প কিছু দিনের মধ্যে লক্ষ্য করলাম বাড়িওয়ালা গাভীর দুধ খাওয়ার জন্য সন্ধ্যায় গোয়াল ঘরে গাভী আর বাচ্চাকে আলাদা করে বেঁধে রাখতো যাতে বাচ্চাটি দুধ না খেয়ে ফেলে। সামনে এস এস সি পরীক্ষা, খুব ভোরে উঠে পড়তে বসতাম। পড়ার ঘরের পাশেই দেয়ালের ওপারে গোয়াল ঘর। ভোর রাত থেকে গাভী আর বাচ্চার সেই হৃদয়বিদারক কান্না শুরু হতো। বাচ্চা মায়ের কাছে যেতে আর মা বাচ্চাকে কাছে পেতে। আমার পক্ষে সে কান্না উপেক্ষা করা সম্ভব হতো না। খুব ভোরে উঠে গিয়ে পকেট গেট খুলে গোয়াল ঘরে বাচ্চার রশির বাঁধনটি খুলে দিয়ে আসতাম। গাভী আর তার বাচ্চার সেই কাঙ্খিত মিলন দেখতাম। আমার মাথায় কাজ করতো না যে, এই জীর্ণ-শীর্ণ বাচ্চার খাবার তাকে না খেতে দিয়ে হাজী নানা কেন নিজে খেতে চান। তিনি চাইলেই তো বহিরে থেকে কিনে খেতে পারেন। প্রতিদিন সকালে যখন বিলাতি আসতেন আর হাজী নানা গিয়ে দেখতেন বাচ্চা সব দুধ খেয়ে ফেলেছে তখন বাচ্চাকে ঠিক মত না বাঁধার জন্য বিলাতিকে আচ্ছা মত বকে দিতেন। বেচারা বিলাতি বকা খেয়ে আমাদের ঘরের পেছনের পুকুর ঘাটে বসে মন খারাপ করে পানির দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আমি পড়ার ঘরের জানালা নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে বিলাতিকে দেখে মন খারাপ করতাম। কিন্তু বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য আমি যে ছেড়ে দেই সে কথা আর বলতে পারিনি কখনো। তবে অপরাধবোধ কাজ করে মনে এখনও। এরপর সে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসি। আজ হাজী নানা, বিলাতি কেউই বেঁচে নেই। আমার আর কখনও বলা হয়নি বিলাতির কোন দোষ নেই, আমিই দোষী। আমিই মা গাভী আর তার বাচ্চার বিচ্ছেদের কান্না উপেক্ষা করতে পারিনি। ক্ষমা করবেন হাজী নানা, ক্ষমা করবেন বিলাতি…..
লেখকঃ Sanjida Mostafij Linda
সহকারী অধ্যাপক (ইতিহাস),
সামাজিক বিজ্ঞান, মানবিক স্কুল,
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর-১৭০৫।
0 Comments