খুব ছোট বেলা থেকে প্রাণীর প্রতি অসম্ভব ভালোলাগা, ভালোবাসা অনুভব করি। এ বয়সে এসেও দূর হতে কোন কুকুর, বিড়ালের কান্নার শব্দ পেলে আর ঘুমাতে পারিনা তাদের কান্না না থামা পর্যন্ত। মনে হয় কোন বিপদ হয়েছে, সাহায্য চাইছে…সে এক অন্য রকম অনুভূতি আমার, যা পরিবারের অনেকের কাছেই হাসি বা বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়। ছোটবেলাটা গ্রামে বড় হওয়ার সুবাদে প্রকৃতি আর প্রাণীদের সাথে আমার একত্রে বেড়ে ওঠা। গৃহপালিত হাঁস, মুরগী, পাখি, খরগোশ, কুকুর, বিড়াল, কবুতরের সাথে মিতালী করেই দিনের শুরুটা হতো। স্কুল ছুটির দিনগুলোতে বাড়ির আশেপাশের জঙ্গলগুলোতে পাখির বাসা খুজতেঁ যাওয়া আর খুজেঁ পেলে ডিম দেয়া থেকে শুরু করে বাচ্চাদের বড় হয়ে বাসা ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা ছিল নিত্যনৈমির্ত্তিক ঘটনা। হাঁস কিংবা কবুতর খুঁজে না পেলে অন্য বাড়িতে গিয়ে তাদেরগুলোর সাথে আছে কিনা তা খুজেঁ দেখা ছিল অন্য রকম আনন্দের বিষয়। বৃষ্টির রাতে বাড়িতে চোর ঢুকলে কুকুরের তাড়া খেয়ে চিৎকার করে পালানোর আওয়াজ শোনা- সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আমার সামনে কোন প্রাণীকে আঘাত করলে কেউই শাস্তি ছাড়া রেহাই পেতোনা। যে কারণে মানুষের চেয়ে প্রাণীর প্রতি দরদ বেশি এ কটূক্তিমূলক তখমাখানা ছোট বেলায়ই অর্জন করেছিলাম। পোষা প্রাণী হারিয়ে গেলে বা মারা গেলে কান্নায় বুক ভাসানো আর নাওয়া খাওয়া বন্ধ করাটাতো এখনও অভ্যাসগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে রয়ে গেছে। ঢাকা শহরে এসেও কুকুর, বিড়াল বা পাখি পোষার মত অভ্যাসগুলো তেমনই আছে। জীবনে অনেক প্রাণী পোষার বা প্রাণীদের সাথে সময় কাটানোর এমনকি তাদের খুব কাছ থেকে দেখে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রাণীদেরও বোধশক্তি আছে ভালো মন্দ বোঝার, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করার। ওরাও ভালোবাসা পেতে চায়, প্রকাশ করতে চায় তাদের নিজেদের ভালো লাগা-মন্দ লাগার অভিব্যক্তি। এ করোনাকালীন সময়ে লকডাউনের দিনগুলোতে পথকুকুরদের খাবার দিতে গিয়ে দেখেছি কিভাবে অচেনা, অদেখা মানুষ শুধু একটু খাবারের বিনিময়ে তাদের কাছে আস্থাভাজন হয়ে ওঠে।
প্রাণীদের অনুভূতি প্রকাশের যে অসীম ক্ষমতা রয়েছে সে অভিজ্ঞতাটা হয়েছিল আমার খুব ছোটবেলায়। হয়তো সেদিন সে প্রাণীটার যে অনুভূতি ছিল আমারও ততটা হয়ে ওঠেনি। সালটা ছিল ১৯৯৪, আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। একদিন সকালে বাবা পুকুরে গোসল করতে নেমে হঠাৎ উঠে পুকুরের অন্য পাড়ে দৌড়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন দুটো কুকুরছানা হাতে। খুব ছোট, মাত্র চোখ ফুটেছে। জানতে পারলাম পুকুর পাড়ে বাশঝাড়ের নিচে একটা মা কুকুর পাঁচটি বাচ্চা দিয়েছিল। মা কুকুরটিকে কে বা কারা তার আগের রাতে বিষ খাইয়েছিল। রাতে মা কুকুরের দুধ খেয়ে সকালের মধ্যেই মা কুকুরটি সহ তিনটি বাচ্চা মারা যায়। বাবা দুটো বাচ্চা আনার পর দুপুরের মধ্যে আরও একটি বাচ্চা চলে গেল। বেচেঁ থাকা একমাত্র কুকুরটির নাম দিয়েছিলাম টমি। খুবই প্রভুভক্ত আর আদুরে কুকুর হিসেবে বেড়ে উঠেছিল সে। বছরখানেক পর ১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি সময় একদিন টমি এক চমক দেখালো। সকালে বাবা অফিস যাওয়ার কিছুক্ষণ পর কোথা থেকে যেন টমি হাপাতে হাপাতে দৌড়ে আসল। কিছুক্ষন চারপাশে ঘোড়াঘুড়ি করে সে আমার জামা টেনে সামনের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। আমি ভেবেছিলাম ও আমার সাথে খেলার চেষ্টা করছে। এরপর দেখলাম ও কিছু দূর নিজে দৌড়ে যাচ্ছে আবার ফিরে এসে আমার জামা ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তখন মনে হলো ও আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর ছোট বোনকে বললাম চল দেখি ও কোথায় নিয়ে যায়। ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে কিছুক্ষণ গিয়ে আবার ফিরে এসে আমাদের দেখে আবারো দৌড়ে সে আমাদের নিয়ে যেতে থাকে আমাদের বাড়ির পাশে থাকা খালের পাড়ে। আমরা যেতে যেতে ততক্ষণে সেখানে আনেক লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল। কাছে গিয়ে দেখলাম খালের পাড়ে একটি সুপাড়ি পাতার বাকলের মধ্যে সদ্য নাড়ীকাটা নবজাতকের লাশ পড়ে আছে। অনেক লোক তা দেখতে ভীড় জমালেও কেউই বাচ্চাটাকে ধরছে না। টমি একবার কাদার মধ্যে নেমে বাচ্চাটার কাছে গিয়ে তাকে শুকে আসছিল আবার ডাকতে ডাকতে এসে আমার পাশে দাড়াচ্ছিল। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া আমার মাথায় সেদিন এ বিষয়টি মিলাতে পারিনি যে কেন একটি সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চা মায়ের কোলে না থেকে খালের পাড়ে পড়ে আছে কিংবা বাড়িতে মারা গেলে সেখানে পরিবারের লোকজন তাকে কবর দেয়নি কেন। আমার মত এক বছর বয়সী টমিও হয়তো সেটা মেনে নিতে পারেনি। তাইতো সে আমাদের ডেকে এনেছিল তাকে উদ্ধার করতে।
কোন মানুষই সেদিন বাচ্চাটাকে ধরতে আসেনি। শুধু দূর হতে দাড়িয়েঁ তামাশা দেখছিল। ঘন্টা তিনেক পর পনেরো-ষোল বছর বয়সী এক রিক্সাচালক ছেলে খালের পাড়ের কাদা মাটির মধ্যে নেমে মৃত বাচ্চাটাকে তুলে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে গোসল করিয়ে কাপড় পেচিয়ে চলে যায় মসজিদের দিকে। অনেক বুঝিয়ে মসজিদের হুজুরকে দিয়ে জানাজা পড়িয়ে ছেলেটা বাচ্চার লাশটিকে তার বাড়ির পাশে কবর দেয়। কবর খোড়া, লাশ কবরে নামানোর কাজটিও ছেলেটি একাই করছিল। সেদিন আমি, আমার ছোট বোন আর টমি সম্পূর্ণ সময়টা সে মৃত বাচ্চাটার সাথেই ছিলাম। টমি মসজিদে জানাজা পড়ানোর সময় বাচ্চার লাশের পাশে বসে ছিল আর কবরে মাটি ফেলার সময় এক পাশ থেকে আচড়ে আচড়ে মাটি ফেলছিল। অবাক করার মত বিষয় হলো আমি আর আমার বোন মানুষ হয়ে কৌতূহলের বসে এত ঘন্টা মৃত বাচ্চাটার পিছনে কাটিয়ে দিয়েছিলাম অথচ টমি পুরো ঘটনার মধ্যে একটা বারের জন্যও আমাদের পাশ থেকে সরে যায়নি। কবর দেয়ার পরও কবরের পাশে টমি বসে ছিল কিছুক্ষণ। এরপর অনেক ডাকাডাকি করে আমাদের সাথে তাকে বাসায় নিয়ে আসি। নাওয়া-খাওয়া, স্কুল বাদ দিয়ে, মা কে না বলে সারাদিন বাহিরে থাকার অপরাধে বাড়ি ফিরে আমরা দুই বোন যখন মায়ের হাতে উত্তম মধ্যম খাচ্ছিলাম তখনও টমি বাহিরে থেকে হাত দুটো জানালার উপরে তুলে আমাদের দেখছিল আর ডেকে ডেকে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল।
টমির এ অনুভূতি আমাকে আজও ভাবায়। মাত্র এক বছর বয়সী একটা প্রাণী হয়েও সে ঠিকই সেদিন বুঝতে পেরেছিল যে মানুষের বাচ্চাটা খালের পাড়ের কাদা মাটির মধ্যে পড়ে থাকার কথা না। বাচ্চাটার আশ্রয়ের প্রয়োজন ভেবেই ও সেদিন আমাকে ডেকে নিয়েছিল। সেদিন না বুঝতে কয়েক বছর পর ঠিকই বুঝতে পেরেছি সেদিনের গ্রামের মানুষগুলো অপয়া, জারজ ভেবেই মৃত বাচ্চাটাকে ধরতেও অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল। অনেকে আবার পুলিশি ঝামেলার ভয় পাচ্ছিল। সেদিন একটা প্রাণের জন্য মানুষে মনুষ্যত্ব খুব একটা কেদেঁছিল বলে আমার মনে পড়ে না। সকলেই কানাঘুষা করতে ব্যস্ত ছিল কোন বাড়ির মেয়ের কোন অপকর্মের ফসল তা উদঘাটনে। এ ঘটনা আমাকে আজও স্মরণ করিয়ে দেয় মানুষের জন্য মনুষত্ব কাদেঁ না বরং প্রাণ কাদেঁ প্রাণের জন্য। আসুন মানুষ হয়ে প্রাণীর
জন্য না প্রাণ হয়ে প্রাণ বাচানোরঁ চেষ্টা করি…
(বি.দ্র. টমির সাথে ধারণকতৃ কোন ছবি এ মুহূর্তে আমার কাছে নেই)
সানজিদা মুস্তাফিজ (লিন্ডা)
সহকারী অধ্যাপক (ইতিহাস)
এস.এস.এইচ.এল, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়, গাজীপুর- ১৭০৫।
0 Comments