বিশ্ববিদ্যালয়ে  প্রথম বর্ষের ছাত্রাবস্থায় প্রায়ই রেস্টুরেন্টে  যাইতাম বন্ধুদের সাথে ।কখনো বিষন্ন মনকে সান্ত্বনা দিতে, কখনো কোনো বন্ধুর জন্মদিনের ট্রিট নিতে, কখনো বা বন্ধুদের হঠাৎ উদ্দেশ্যহীন যাত্রায়। অগ্রহায়ন মাসের মধ্যভাগ, তখন শীতকাল না হলেও সন্ধ্যা নামলে হালকা শীতের অনুভুতি হয়। এমন এক সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে উদ্দেশ্যহীন যাত্রায় ক্যাম্পাসে হাটতেছিলাম।সেমিস্টার ফাইনাল থিওরি পরিক্ষা শেষ, দুদিন বাদেই প্রাকটিক্যাল শুরু হবে, একটু রিফ্রেশমেন্টের জন্য বেরিয়েছি। ফুসকা চত্বরে আসতেই ক্যাম্পাসের সাদা কুকুরটা যেন কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমাদের সাথে হাটতে লাগল।ওর নাম ট্রাম্পি। ক্যাম্পাসের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তার পদচারণ নেই। ছেলেদের হল, মেয়েদের হল, সকল ফ্যাকাল্টি,টিএসসি, প্রশাসন ভবন থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা জায়গার ধুলিকণার লেগে আছে তার গায়ে।সিকৃবি ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত কোনো ন্যাশনাল কিংবা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স,সভা সেমিনারও বাদ যায়না তার। সে এতটাই বিশ্বস্ত যে ক্যাম্পাসে কোনো পরিচিত বা অপরিচিত ব্যাক্তি তার নাম ধরে ডাকলে মুহূর্তেই তার বন্ধু হয়ে যায়।
তার সেই গুনাবলীতে সে আমাদের সাথে হাটতে হাটতে ভার্সিটি ফার্স্ট গেইটে আসল। আমরা কোন দিকে যাবো তারও কোনো উদ্দেশ্য নাই। আবার হাটা শুরু মাদানি ঈদ গাঁও ময়দানের দিকে। ট্রাম্পিও আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে এগুচ্ছে আমাদের সাথে, কখনো সামনে দৌড় দিয়ে আগায়, কখনো পিছনে পড়ে। অতিথী ভবন পার হয়ে যুব উন্নয়ন ভবনের সামনে এসেই ক্যাম্পাসের সীমানা শেষ। হঠাৎ সানির প্রস্তাব যে চলো সবাই বিরিয়ানি খেতে যাই। দুই- একজন অমত দিলেও সবাই রাজি হয়ে গেলাম।
কোথায় যাবো?
শিবগঞ্জ,পানসী রেস্টুরেন্ট।
ট্রাম্পি আমাদের সাথে দাড়িয়ে প্ল্যান শুনতেছে।  কুরকুরে বলল,‘ট্রাম্পিকেও আজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাব। কিরে ট্রাম্পি যাবি নাকি?’।এই কথা শুনে তো সে খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলো  যা সে লেজ নেড়ে জবাব দিল হ্যা আমিও যাব। কিন্তু দু-তিনজন বলল না এটাকে নিয়ে ঝামেলা বাড়ানোর দরকার নাই, বলেই ট্রাম্পিকে ধমক দিয়ে বলল, ‘এই ট্রাম্পি, যা ক্যাম্পাসে ফিরে যা’।কিন্তু তার ক্যাম্পাসে ফেরার কোনো লক্ষনই দেখা গেল না। আমরা সামনে হাটতে ধরলে সে পিছে পিছে হাটা শুরু করে। উপায় না দেখে তাকে সাথে নেয়া হল। সে লাফিয়ে লাফিয়ে আমাদের সাথে টিলাগড় উদ্দেশ্য হাটতে লাগল।  এমসি কলেজ ২য় গেটের সামনে এসেই ট্রাম্পিকে নিয়ে পড়লাম ভয়াবহ বিপদে। সেখানে ছিল একটি কুকুর। সে ট্রাম্পিকে দেখে আক্রমণের চেষ্টায় ধাওয়া করলে ট্রাম্পি ভয়ে আমাদের সবার গায়ের কাছে এসে দাড়ায় আবার আমাদের সাথে পেয়ে সাহস পেয়ে মিছামিছি ঘেউঘেউ করে ।তখন আমি আর কুরকুরে, দুজন ট্রাম্পিকে ধমক দিয়ে ওর গলার বেল্ট ধরে প্রটেকশন দিচ্ছিলাম আর বাকি পাঁচ জন সেই স্থানীয় কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিয়ে  সেই আক্রমণ থেকে কোন রকমে রক্ষা করলাম। আসলে ট্রাম্পি তার রাজ্য সিকৃবি ক্যাম্পাসে রাজা হলেও তার টেরিটোরির বাহিরে ভীতু সৈনিক। টিলাগড় পয়েন্ট হয়ে শিবগঞ্জ রোডে হাটার সময় সে অনেক গাড়িঘোড়া দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিল। মেইন রোড থেকে গলি রাস্তা পেলেই সে সেদিকে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছিল। তাকে ধমক দিয়ে আবার আমাদের সাথে নিয়ে হাটছিলাম।
তাকে কড়া নজরে রেখে অবশেষে শিবগঞ্জ পানসী রেস্টুরেন্টে পৌছালাম। এখন ট্রাম্পিকে ভিতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়া দরকার। তারা ট্রাম্পির সৌন্দর্য ও বিশ্বস্ততা দেখে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিলো। সে আমাদের সাথে শান্তশিষ্ট ও ভদ্রলোকের মতো ভিতরে ঢুকে পড়ল। ভিতরে অনেক লোক খাচ্ছে। সকল লোকের কথা ভেবে আমরা পিছনে ২য় গেটের কাছের টেবিলে বসলাম। ট্রাম্পিকে টেবিলের পাশে বসতে বললাম, সে ভদ্রভাবে বসে বিশ্রাম করতে শুরু করল। অনেক দুর পথে হেটে এসেছে। হাপিয়ে গেছে,বেশ ক্ষুধাও লেগেছে ওর। আমাদের বিরিয়ানির অর্ডার করা হলো।আসতে কমপক্ষে ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।  তাই আমি আর কুরকুরে একটি রুটি কিনে এনে তাকে খেতে দিলাম। সে সেটি খেয়ে নিয়ে সুন্দর করে বসে বিশ্রাম করতেছিল। আশে পাশের টেবিল গুলোতে অনেক লোক খেতেছিল, তাদের খাবার তাকে বিন্দুমাত্র লোভাতুর করেনি, সে শান্তভাবেই আমাদের পাশে বসে আছে, এমন শান্তশিষ্ট, ভদ্র স্বভাব ও শারীরিক সৌন্দর্যের কারনে ওয়েটারসহ সকলেই মুগ্ধতার চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর ওয়েটার আমাদের অর্ডার নিয়ে আসলো । এবার আমাদের টেবিলে খাবার দেখে সে লোভাতুর হয়ে উঠলো, সে লেজ নাড়িয়ে এমনটাই বুঝিয়ে দিল আর এমন ভাব করল যেন তার অভিযোগ ,‘ আমাকে না দিয়ে তোমরা একাই ভালো খাবা তা হবে না আর যেহেতু আমাকে সাথে নিয়ে এসেছো আমাকেও ভালো খাবারের ভাগ দিতে হবে’। আমরা বন্ধুরা সবাই সবার প্লেট থেকে একটি করে হাড় তাকে খেতে দিলাম, সে খেয়ে পিছন গেটের সামনে বসে কৃতজ্ঞতার সুরে মাথা মাটিতে নুইয়ে দিয়ে শুয়ে রইল, আমাদের ভোজন শেষ অবধি সে বসে রইলো।
এবার ট্রাম্পির রাজ্যে ফেরার পালা।  কোনদিক দিয়ে ফিরবো,টিলগড় পয়েন্ট দিয়ে নাকি শিবগঞ্জ থেকে বালুচর পয়েন্ট দিয়ে এই সংশয়ের মাঝে  ঠিক করলাম বালুচর হয়েই ক্যাম্পাসে ফিরব। সান্তু ও তনু অলস প্রকৃতির না হলেও তারা আর হাটতে পারবে না, ট্রাম্পিকে নিয়েও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা রিকশা নিয়ে আমাদেরকে ছেড়ে চলে এলো। এখন আমরা পাঁচ জন আর ট্রাম্পি ধীরে ধীরে হেটে আগাতে লাগলাম । কিছুদুর আগাতে একটি দোকানের সামনে একটি কুকুর ট্রাম্পিকে দেখে আক্রমণ করার চেষ্টা করলেও দোকানিদের ধমক ও আমাদের প্রটেকশনে সে কিছু করতে পারেনি।
যত পথ আগাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে কোলাহল, গাড়িঘোড়া মুক্ত নিরব রাস্তা।  একটা মোড় ঘুড়েই একটু এগিয়ে ট্রাম্পিকে নিয়ে পড়লাম ভয়াবহ বিপদে। একটা বাসার সামনে প্রায় চার-পাঁচটা কুকুর । সব কুকুর চারদিক থেকে ট্রাম্পি ও আমাদেরকে আক্রমন করে বসল। আমাদের দিকে কুকুর গুলো তেড়ে আসতেছিল। আমাদের হাতের কাছে কিছু ছিলনা ঐ হিংস্র কুকুর গুলোকে প্রতিহত করার। একজন মাঝখানে ট্রাম্পিকে ধমক দিয়ে ঘেউঘেউ থামানোর চেষ্টা করছিলাম  আর চারজন চারপাশে কুকুর গুলোকে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু লোকসংখ্যা কম হাওয়ায় হিংস্র কুকুরকে তাড়ানো খুব একটা সহজ ছিলো না। একদিক তাড়িয়ে দিই তো অন্য দিকে এসে আক্রমণের চেষ্টা করে। আমরা না পারছিলাম সামনে আগাতে না পারছিলাম পিছনে পিছাতে! এমন সময় একটি রিকশা এলো। রিকশাতে দুজন ভদ্রলোক। রিকশাওয়ালা সহ তিনজন।তারা আমাদের এরকম পরিস্থিতি দেখে তারা সাহায্য করার জন্য রিকশা থেকে নেমে কুকুর গুলোকে তাড়াতে লাগল। তাদের সহযোগিতায় আমরা ট্রাম্পিকে নিয়ে ঐ জায়গা থেকে দ্রুত সরে পড়লাম। এভাবে কঠোর নজরদারি রেখে বালুচর পয়েন্ট পৌছালাম।  পয়েন্ট থেকে ক্যাম্পাস রোডে আরো দু-তিনবার কুকুরের ধাওয়া খেয়েছে ট্রাম্পি তবে সেগুলো ততটা হিংস্র ছিল না। ক্যাম্পাসে ঢুকেই সে একটি ভোঁ দৌড় দিলো।তার রাজ্য বলে কথা! তাকে আবার ডেকে আনলো কুরকুরে। আমাদের সাথে আমাদের রুমে চলে আসল।অনেকটা পথে হেটেছে। রুমের দরজার সামনে বসে হাঁপাচ্ছে। রেস্টুরেন্টে যা খেয়েছে রাস্তার কুকুরের ধাওয়া খেয়ে দীর্ঘ পথ হেটে সব হজম হয়ে গেছে। আমার টেবিলে একটা বিস্কিটের প্যাকেট ছিল। রুমের ভিতর নিয়ে এসে ফ্যানের নিচে বসিয়ে সেই বিস্কুট খেতে দিলাম। খেয়ে রুমের বাহিরে গিয়ে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে বসে রইলো । তখন আমি ট্রাম্পির চোখের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করলাম পৃথিবীতে কোনো জীব একটি নির্দিষ্ট সীমার বাহিরে ক্ষমতাশীল নয়, পশুপাখি খুব সহজেই একজন মানুষের বিশ্বস্ততা ও ভালোবাসা  অর্জন করতে সক্ষম। ট্রম্পির মতো আদর-স্নেহ, ভালোবাসা পেলে হয়ত রাস্তার ধারে ঘুরে বেরানো কুকুর গুলো হিংস্র হতোনা কখনো, আক্রমণ করত না কাউকে।
লেখা-
আব্দুল্লাহ আল মামুন,
ফ্যাকাল্টি অফ ভেটেরিনারি এনিমেল এন্ড বায়োমেডিকেল সায়েন্সেস,
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
কনট্যাক্ট:০১৭৫০১৩১৯৬২
 ই-মেইল:
ঠিকানা: গ্রাম:যমুনা বর্মতত, পোস্ট অফিস : মন্ডলের হাট, ইউনিয়ন :দূর্গাপুর
উপজেলা :উলিপুর, জেলা: কুড়িগ্রাম

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *