বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস ২০১৯ উপলক্ষ্যে প্রাধিকারের আয়োজনে সিলেটের প্রাণি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা আরও ৩ টি সংগঠন গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটি (শাবিপ্রবি), ভূমিসন্তান বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর যৌথ উদ্যোগে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে “সিলেটের বন্যপ্রাণী ব্যাবস্থাপনাঃ ভবিষ্যৎ ও করণীয়’’ শীর্ষক গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো।
বিকাল ৩:৩০ ঘটিকায় সিকৃবির ভেটেরিনারি, এনিম্যাল এন্ড বায়োমেডিকাল সায়ন্সেস অনুষদ এর কনফারেন্স রুমে শুরু হওয়া এই গোল টেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রাধিকার এর সম্মানিত উপদেষ্টা ভেটেরিনারি অনুষদের মাননীয় ডিন অধ্যাপক ডঃ এ.টি.এম মাহবুব ই ইলাহি। উক্ত বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আর.এস.এম মনিরুল ইসলাম। প্রাধিকার উপদেষ্টা পরিষদ থেকে উপস্থিত ছিলেন সিকৃবির বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডঃ মোঃ মেহেদী হাসান খান, অধ্যাপক ডঃ মোঃ মোহন মিয়া (জেনেটিক্স এন্ড এনিম্যাল ব্রিডিং বিভাগ) , সহযোগী অধ্যাপক ডঃ মাহফুজুর রহমান (মেডিসিন বিভাগ) । এছাড়াও যে সকল সংগঠন এর উদ্যোগে এই গোল টেবিল বৈঠক এর আয়োজন তাদের মধ্যে ভূমিসন্তান বাংলাদেশ এর সিলেট শাখার সমন্বয়কারী আশরাফুল কবির, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম চৌধুরী ক্বীম, গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটি (শাবিপ্রবি) এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সহ অন্যান্য কমিটি সদস্য, এবং “প্রাধিকার’’ এর বর্তমান ও সাবেক কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক সহ অন্যান্য কমিটির সদস্যরা।
সম্পূর্ণ গোল টেবিল বৈঠক টি সঞ্চালন করেন প্রাধিকার নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দীন হায়দার রিফাত।
গোল টেবিল বৈঠকের শুরুতেই এই বৈঠকের উদ্দেশ্য এবং এজান্ডা গুলো আলোচক দের সামনে তুলে ধরেন গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটি এর সাধারণ সম্পাদক তাসনিমা মুকিত।
এরপর সিলেট বিভাগে কিভাবে এই পরিবেশবাদী সংগঠন গুলো কাজ করে যাচ্ছে এবং কাজ করার সময় কি কি অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে এগুলো প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরেন প্রাধিকার কোষাধ্যক্ষ আহমেদ রাফি।
এরপর বক্তব্য নিয়ে আসেন প্রাধিকার বর্তমান কমিটির সভাপতি মোঃ আনিসুর রহমান। তিনি শুরুতেই এবারের বন্যপ্রাণী দিবস ২০১৯ এর প্রতিপাদ্য বিষয় ‘Life below water: for people and planet’ এর উপর আলোকপাত করে বলেন সিলেটের অন্যতম একটি নদী হচ্ছে সুরমা নদী। আর প্রতিনিয়ত এই নদী দূষণের ফলে সিলেটের নদীর জীববৈচিত্র যেভাবে হুমকির সম্মুখিন একই ভাবে হুমকির সম্মুখিন পাখি এবং আমরা মানুষেরা। এগুলো রক্ষায় আমাদের এখুনি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বক্তব্য রাখেন গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটির সভাপতি হাসনাইন আহমেদ। তিনি বলেন জাফলং, রাতারগুল সহ বিভিন্ন জীব বৈচিত্র সমৃদ্ধ এলাকায় আমরা আমাদের বিরুপ কাজের মাধ্যমে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র ধংস করছি। বিভিন্ন প্রজাতি সংরক্ষণে এখুনি যদি আমরা যথাযথ পদক্ষেপ না নেই তাহলে সামনের দিন গুলোতে তা আমাদের ই বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
ভূমিসন্তান বাংলাদেশ সিলেট শাখার সমন্বয়কারি আশরাফুল কবির বলেন আজ থেকে ২ যুগ আগেও প্রচুর দেশিও মাছ, পাখি বিভিন্ন প্রজাতির ফলের গাছ সিলেটে ছিলো যা আজ প্রায় নেই বললেই চলে। জাফলং এ প্রতিনিয়ত পাথর উত্তোলনের ফলে সেখানকার পরিবেশ আর বিপর্যস্ত। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের সকলের সমন্বিত উদ্বোগ প্রয়োগ প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম চৌধুরী ক্বীম বলেন বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বাঁচাতে আমাদের সবাইকে নিজের ভালোবাসা থেকে কাজের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। এবং এইসব কাজে সাংবাদিক দের গুরুত্ব খুব বেশি বলে তিনি জানান। প্রতিনিয়ত বন দখল, নদী দখল এর ফলে আমাদের জীববৈচিত্র আজ মারাত্নক হুমকির মুখে। আর এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারী ভাবে কর্মসূচী নেয়ে প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
এছাড়াও গোল টেবিল বৈঠকে আলোচনায় উঠে আসে সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় বানর এর সাথে মানুষের বিবাদ, প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাণির খাদ্য সংকট। এ থেকে বাঁচার জন্য প্রাধিকার কর্মী নাজমুল ইসলাম মানিক বেশ কিছু প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো বানরের খাবারের জন্য বনে কলাগাছ রোপণ, অজগরের খাবারের জন্য খরগোস এর প্রজনন, গাছে পাখির জন্য বাসস্থান এর ব্যবস্থা ইত্যাদি।
ভূমিসন্তান বাংলাদেশ এর কর্মী শরীফুল ইসলাম হরিপুরে অতিথি পাখি খাওয়া নিয়ে সমস্যা তুলে ধরেন এবং এই সমস্যা সমাধানে সরকারী ভাবে যথাযথ উদ্যোগ নেয়ার জন্য আহবান করেছেন। এছাড়াও খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে যাতে রাতে অতিরিক্ত জোরে শব্দ করে বা গান করে বন্যপ্রাণির কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হয় এজন্য বন কর্মকর্তাদের সহায়তা চেয়েছেন।
প্রাধিকার সাবেক সভাপতি মঞ্জুর কাদের চোধুরী টিলাগড়ে বন্য প্রাণি সংরক্ষণ কেন্দ্রের তৎপরতা আরও বৃদ্ধি কথা জানিয়ে এর মধ্যে অবকাঠামোগত এবং ব্যাবস্থাপনা আরও উন্নত করার আহবান জানিয়েছেন যাতে করে সেখানকার প্রাণী গুলো তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে এবং উদ্ধারকৃত আহত প্রাণিদের যাতে ভালোভাবে সেবা প্রদান করা যায়।
প্রাধিকার উপদেষ্টা ডঃ মাহফুজুর রহমান বলেন আমাদের সবার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সমন্বিত ভাবে আরও ভালোভাবে কাজ করে যেতে হবে। এছাড়াও টিলাগড় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের কার্যক্রম আরও ভালোভাবে পরিচালনার জন্য তিনি সিকৃবির ভেটেরিনারি অনুষদের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের আহবান জানান।
প্রাধিকার উপদেষ্টা অধ্যাপক ডঃ মোহন মিয়া বলেন জাতীয় পর্যায়ে আরও ভালোভাবে পরিকল্পনা নেয়া এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আর.এস.এম মনিরুল ইসলাম বলেন বন্যপ্রানী এবং জীববৈচিত্র রক্ষায় বিশ্বব্যাপী যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে তা আরও অনেক আগে শুরু হওয়া দরকার ছিলো। তিনি সিলেট সম্পর্কে বলেন সিলেট এর প্রাণি এবং জীববৈচিত্র অনেকাংশেই হাওর এর উপর নির্ভরশীল। আর এই হাওর গুলো বর্তমানে অনেক হুমকির মুখে। এজন্য সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে ভালোবেসে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি চা-বাগানের স্কুল গুলোতে সচেতনতা মূলক ক্যাম্পেইন করার পরিকল্পনা জানান। এছাড়াও সরকারী পক্ষ থেকে যেনো কোনো ফান্ড এর ব্যবস্থা করা যায় এজন্য সরকারের উপর মহলে কথা বলবেন বলে আশ্বাস দেন। এছাড়াও টিলাগর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের সুযোগ সুবিধা আরও বৃদ্ধি, ভালো ব্যবস্থাপনা এবং এর মধ্যে অবাধে মানুষের যাতায়ত রোধে খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ে হবে বলেও বলেন তিনি।
এছাড়াও রাতারগুল বাঁচাতে বিশ্বব্যাংক এর সাথে যৌথ বাজেটে প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে বলেও জানান।
গোল টেবিল বৈঠক এর সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক এ.টি.এম মাহবুব ই ইলাহি বলেব বন্যপ্রাণী সংরক্ষনে সিকৃবির ভেটেরিনারি অনুষদের পক্ষ থেকে সকল প্রকার ক্লিনিকাল সুবিধা সর্বদা দেয়া হবে। তিনি বলেন প্রাণিদের উপর আমরা যেভাবে নির্ভরশীল তারাও একই ভাবে আমাদের উপর নির্ভরশীল। আমাদের নিজেদের বাঁচার জন্যে হলেও আমাদের প্রাণি বাচানোর জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
এছাড়াও তিনি এইরকম কার্যকরী একটি গোল টেবিল বৈঠক এর আয়োজন করায় পরিবেশবাদী সকল সংগঠনকে ধন্যবাদ জানান।
0 Comments