বছর দুইএক আগের কথা, খুব একটা পোষাপ্রানী ছিলাম না। সব সময় হীনমন্যতায় ভুগতাম ভেটেরিনারি পড়ে আদৌ জীবনে কি লাভ!  মনে মনে সবসময় বলতাম আল্লাহ আমাকে ডাক্তারই যখন বানালে এসব গরুছাগল, কুকুর বিড়ালের কেন? 

এসব হীনমন্যতার মূল কারন ছিল আশেপাশে মানুষের তুচ্ছতাচ্ছিল্য, আশেপাশের মানুষের কথা কি বলব পরিবারের অনেক সদস্য বুঝতো না, আমিও বলতে পারতাম না।  এসব হীনমন্যতা সঙ্গী করে, ডিভিএম এর ৯ থেকে ৫ টার ক্লাস পরীক্ষায় অতিবাহিত হতে লাগল সময়..
 এবার সেমিস্টার ফাইনালের ছুটিতে আমাদের পরিবারের সবাই নরসিংদির ড্রিম হলিডে পার্ক যাবো ঠিক করলাম, দিন গিয়ে দিনে আসা যাবা এজন্য, যাকে বলে একদিনের ভ্রমণ। যথারীতি গেলাম, আসার সময় ট্রেন বাড়ি ফিরছিলাম।  হঠাৎ দেখি সীটের নিচ থেকে  এক ধবধবে    সাদা বিড়াল  বের হয় পায়ের কাছে বসে আছে।সবাই অবাক, চিৎকার চেঁচামেচা ট্রেনে বিড়াল আসলো কেমন করে, তাড়ানোর অনেক চেষ্টা করেও লাভ হলনা। বিড়ালটা খুবই সুন্দর ছিল,   কিন্তু দূর্বল ও অসুস্থ  বুঝাই যাচ্ছিল। কি জানি হল আমার, কেমন একটা মায়ায় পড়ে গেলাম আর ভাবতে লাগলাম মানুষ হলে ঠিক বলতে পারত ” আমি দুদিনের অনহারী দুইটা টাহা দেন, চাইরডা ভাত খামু”
নিজের অজান্তেই দু’চোখ এ পানি আসল..
যাক অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ি নিয়ে, আর আনন্দ ও হল আমি তো ওদেরই ডাক্তার।  ওদের কষ্ট তো আমাকেই বুঝতে হবে। আর বিড়ালও অনেক সুন্দর, রাস্তাখাটে এমন বিড়াল কমই পাওয়া যায়। আবার এটাও মনে হল কারো পোষা বিড়াল কিনা, ভুলে চলে আসলো কিনা, কত প্রশ্ন!!!  আম্মা বলে এত না ভেবে নিয়ে চল বাড়িতে..
বাড়িতে নিয়ে আসলাম।গোসল করিয়ে মাছ দিলাম খেতে, বেশ সুস্থ আর সুন্দর লাগছে। শরীরের কেটে যাওয়া জায়গায় ডেটল লাগিয়ে দিলাম, কিছুদিনের মাঝে  সম্পূর্ন সেরে ওঠল। একটা  নামও দিলাম ” সাদাবিলি “।  আমাদের পরিবারের সবার আদরের ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠল সাদাবিলি।   আমি তখন খুব একটা ওষুধের নাম বা চিকিৎসা পারতাম না। আমার ছোট বোন বেশি খুশি ছিল বিড়াল পেয়ে, আমাকে খালি বলত ” তুই না কুকুর বিড়ালের   ডাক্তার!  এমন কি ঔষধ নাই বিড়াল মোটা হবে?  লোমগুলো বড় হবে?  আমি হাসলাম ( হা হা হা)  … তারপর এক ভাইয়ের কাছ থেকে  কিছু ঔষধের নাম জেনে নিলাম, যেন সাদাবিলি মোটা আর তুলতুলে হয়..  নাইনসিয়াস নামের সিরাপ খাওয়ালাম, আল্লাহর রহমতে সাদাবিলি আরো সুর্দশন সুস্বাস্থের অধিকারী হয়ে গেল…  নিজের পেশার প্রতি ভালো লাগা শুরু করল….
সেই থেকে  আমি আর হীনমন্যতায় ভুগিনা । বুঝতে পারলাম, কুকুর বিড়াল গরু ছাগলসহ যত বোবাপ্রানীর চিকিৎসার দরকার আছে, চিকিৎসকের প্রয়োজন আছে তার জন্য দরকার ভেটেরিনারি। সকল প্রানীরই একটা অধিকার আছে,  তাদের খাবার পাওয়ার অধিকার, তাদের সেবা পাওয়া ও নিরাপদ আশ্রয়ের দরকার  আছে।  আমি মনে মনে ভাবতাম ইস!  এমন যদি একটা প্রতিষ্ঠান থাকত  তারা ক্ষুদার্ত  প্রানীর খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করবে..  এসব ভাবতে ভাবতে  ক্যাম্পাসে ”  প্রাধিকার “এর কথা মনে পড়ল আর আত্ম তৃপ্তিতে মনটা ভরে ওঠল, ” প্রাধিকার” তো ওদের  নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করতেই কাজ করছে, ওদের প্রতি নিষ্ঠুরতম আচরন বন্ধ করতেই কাজ করছে। দুনিয়াতে এখন ও বিবেকবান মানুষ আছে বলেই প্রানীর অধিকার নিয়ে ভাবে। মনে মনে খুব খুশি হলাম আর ভাবলাম  সিকৃবিতে চান্স হয়ে ভালোই হল।
প্রাধিকার সিকৃবির ভিন্নধর্মি একটা সংগঠন, যা অন্য কোনো ক্যাম্পাসে নাই, এটা নিয়ে একটু হলেও ভাব ধরা যাবে… হা হা হা       সবাই হয়তো বুঝেনা ভেটেরিনারি কি?
 যারা বুঝেনা এটা তাদের ব্যর্থতা। আর সবার সব বুঝতে হবে তারও কথা নেই। একটা সময় আল্লাহকে বলতাম কি কুকুর বিড়ালের ডাক্তার বানালে আর এখন বলি  আলহামদুলিল্লাহ।এখন সবই বদলে গেছে কোথাও কুকুর বিড়াল দেখলেই আমি খেতে দেই, অসুস্থ কোনো বিড়াল পেলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি..
সবই আসলে ওই একদিনের ভ্রমণ বিভ্রাট আর সাদাবিড়ালের উসিলায় হল..
জাকিয়া সুলতানা (কলি)
ইন্টার্ন ডাক্তার ( লেভেল -৫, সেমিস্টার -১)
ভেটেরিনারি, অ্যানিমেল ও বায়োমেডিকেল সায়েন্স অনুষদ
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *