নাসির উদ্দিন

 বিশ্বের একক বৃহত্তম জোয়ার ভাটার বন সুন্দরবনের ভারত অংশে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি দেশটির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের প্রকাশ করা সুন্দরবনের ব্যাঘ্র প্রকল্প ২০১৯-২০ সালের বাঘশুমারি প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে আটটি। এর আগে ২০১৭ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৮৮, ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৯৬টি। এ নিয়ে পর পর তিন বছর বাঘের সংখ্যা বেড়েছে সুন্দরবনের ভারত অংশে। যা সর্বোচ্চ বলে দাবি করেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার।

সমগ্র বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসের মহামারিতে বিপর্যস্ত তখন বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি নি:সন্দেহে সুখবর বলা চলে। সেইসঙ্গে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে দেশটির বলিষ্ঠ ভূমিকারই বহি:প্রকাশ হিসেবেও গণ্য করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭তে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের সজনেখালি রেঞ্জে ১৪টি বাঘ ছিল। বসিরহাট রেঞ্জেও ছিল একই সংখ্যা। সুন্দরবন জাতীয় উদ্যানের পশ্চিম এবং পূর্বে বাঘের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৯ ও ১৬টি। দক্ষিণ ২৪ পরগনা ডিভিশনে ওই সময় বাঘের সংখ্যা ছিল ২৪টি।

এ বছর সুন্দরবনের সব এলাকাতেই বেড়েছে বাঘের সংখ্যা। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এখন সজনেখালি রেঞ্জে ১০টি বাঘ রয়েছে। বসিরহাট রেঞ্জে রয়েছে ১৯টি বাঘ। জাতীয় উদ্যানের পশ্চিম ও পূর্বে বাঘের সংখ্যা এসে ঠেকেছে যথাক্রমে ২০ এবং ২৪-এ। দক্ষিণ ২৪ পরগনা ডিভিশন রেঞ্জে এই মুহূর্তে বাঘ রয়েছে ২৩টি।

গত বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে সুন্দরবনে ব্যঘ্রসুমারি শুরু হয়, যা চলে এ বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ডব্লিউ-ডব্লিউ-এফ এর প্রযুক্তিগত সাহায্য ও দুইশত জোড়া ক্যামেরা দিয়ে বাঘ গণনার কাজ শুরু হয়। ৯৬টির মধ্যে ৪৩টি বাঘের লিঙ্গ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি স্ত্রী বাঘ। ক্যামেরার ডেটা বিশ্লেষণ করে এই কাজ সারতে সাধারণত ৫-৬ মাস সময় লাগে। এতে রিক্যাপচারিংয়ের সম্ভাবনাও থেকে যায়, যা কিনা বিশেষ সফ্টওয়্যারে ফেলে যাচাই করতে হয়। যাতে নিশ্চিত করা যায় যে একটি বাঘকেই দু’বার করে গণনা হচ্ছে না। তবে সবকিছু যাচাই করে এবারে দ্রুতই গোটা কাজটি সম্পন্ন করা গেছে বলে জানায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার।

একইভাবে ২০১৯ সালে ইউএসএইড বাঘ প্রকল্পের সহযোগিতায় বাঘ গণনা জরিপে বাংলাদেশের সুন্দরবনেও বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৫- ২০১৯ পর্যন্ত বাংলাদেশেও বাঘ বৃদ্ধি পেয়েছে মোট ৮টি। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বনবিভাগ সর্বপ্রথম ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে সুন্দরবনে বাঘ জরিপ করে। ওই সময় বাঘের সংখ্যা ১০৬টি নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে ২০১৯ সালে একই পদ্ধতির জরিপে বাঘ পাওয়া যায় ১১৪টি।

সুন্দরবনে একটি পুরুষ বাঘ ৮০-১০০ বর্গকিলোমিটার এবং মেয়ে বাঘ ২০-২৫ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে বিচরণ করে থাকে। যা প্রাণীটির নির্দিষ্ট বিচরণক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। আর বাংলাদেশ ও ভারতের অংশ মিলিয়ে যেহেতু সুন্দরবন এলাকা, কাজেই একাংশে বাঘ বৃদ্ধির মানে অপর অংশেও বাঘের সংখ্যা ভালোই আছে। কারণ বাংলাদেশের সুন্দরবনের পশ্চিম অংশ এবং ভারতীয় সুন্দরবনের পূর্বের অংশ একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকায় সহজেই বাঘেরা আসা-যাওয়া করতে পারে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অংশে বাঘ বৃদ্ধির খবর নির্দিধায় বাংলাদেশ অংশের বনে বাঘের অস্তিত্বের জন্যও সুখবর।

সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। যা বাংলার বাঘ হিসেবে পরিচিত দুই বাংলার মানুষের কাছে। বাঘের উপস্থিতি যেমন সুন্দরবনের পরিবেশ সংরক্ষণে সহযোগিতা করে তেমনি দুই বাংলার মানুষের সংস্কৃতি, জীবন এবং গর্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। চোরা শিকার, বাঘের আবাস্থলের উপর মানুষের প্রভাব, বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ শিকার, বাঘ মানুষের দ্বন্দ্ব, বাঘ ও তার প্রধান শিকার হরিণের রোগ বালাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত লবনাক্ততা বাঘ সংরক্ষণের অন্যতম অন্তরায় বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে।

সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন মাছ, মধু, কাকড়া, গোলপাতা ইত্যাদি সুন্দরবনের নিকটবর্তী মানুষের জীবন ধারণের প্রধান উপলক্ষ্য। দুই বাংলায় কমপক্ষে ১০-১৫ লক্ষ্য মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য বিভিন্নভাবে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই বাঘ সংরক্ষণের জন্য বাঘের পাশাপাশি সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন-জীবিকার কথাও ভাবতে হবে। বাঘ সংরক্ষণে বাংলাদেশ ও ভারতে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সুন্দরবনের নেয়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম হল স্মার্ট পেট্রোল কার্যক্রম, যা ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয়ে এখনো চলমান। সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামগুলোতে কমিউনিটি পেট্রোলিং কার্যক্রম, অভয়ারণ্যের আয়তন বৃদ্ধি করে বাঘ সংরক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে যৌথভাবে বন্যপ্রাণী শিকার নিয়ন্ত্রণ, দস্যু দমন, বাঘ সংরক্ষণে ভিলেইজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন, শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, বন বিভাগ ও স্থানীয় জনগনের দক্ষতা বৃদ্ধি করাসহ বাঘ সংরক্ষণে স্থানীয়দের উদ্ধুদ্ধ করার কার্যক্রম চলছে।

একইভাবে ভারত অংশের সুন্দরবনে চোরা শিকার নিয়ন্ত্রণে এম স্ট্রাইপ টহল ব্যবস্থা, স্থানীয় জনসাধারণকে নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা, বাঘ ও মানুষের সংঘাত নিরসনে সুন্দরবনের ঘেষে নাইলন নেটের ঘেরা দেয়া, সংঘাত প্রবণ এলাকাগুলাতে সৌর বাতির মাধ্যমে গ্রামে ঢুকে পড়া বাঘকে বনে ফেরত পাঠানো, প্রধান রাস্তাগুলোতে বাতি বসানোর মাধ্যমে চোরা শিকার প্রতিরোধ করাসহ নানান পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

বাঘ সংরক্ষণে উক্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে গোটা সুন্দরবনেই বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেহেতু সুন্দরবনের দুই অংশই একে অপরের পরিপূরক, সুতরাং বলা চলে দু’দেশেই বাঘ সংরক্ষণের পদক্ষেপগুলো নি:সন্দেহে সঠিক ও আধুনিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বাঘ বাংলাদেশ ও ভারত, দুই দেশেরেই সংষ্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই আগামীতে বাঘকে টিকিয়ে রাখতে দু’দেশের মধ্যে যৌথ সংরক্ষণ উদ্যোগ নেয়াসহ পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন।

লেখক:নাসির উদ্দিন

বন্যপ্রাণী ও বাঘ গবেষক, বাংলাদেশ।

 

Categories: Wildlife

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *